‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে/ভাগ হয়নিকো নজরুল’ ১৯৪৯ সাল, ভারত বিভাগের দুবছরের মধ্যে অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা কবিতার মর্মবাণী যেন আবারও জানান দিয়ে গেল, দ্রোহ ও প্রেমে, কঠোর ও কোমলে অম্লান, অসাম্প্রদায়িক ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম আজও বাঙালির মনে চিরভাস্বর হয়ে আছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় চিত্রায়িত ভারতীয় হিন্দি সিনেমা ‘পিপ্পা’য় নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানের বিতর্কিত সুর সংযোজনা নিয়ে উভয় বাংলার মানুষের তীব্র প্রতিক্রিয়া অন্তত তাই বলে দিচ্ছে। ভারতের স্বনামধন্য সংগীতকার এ আর রহমান নজরুলের গানের যে বিকৃতি ঘটিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতারা যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, এর আগে বোধকরি নজরুলের কোনো সৃষ্টি নিয়ে এত আলোচনা হয়নি। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সংগীত ও সাহিত্যানুরাগীদের নজরুলের সৃষ্টি নিয়ে এত আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। শুনতে খারাপ লাগলেও এ কথা বলতেই হয়, ওপার বাংলায় নজরুল তার প্রাপ্য কদর থেকে বরাবরই বঞ্চিত ছিলেন। বিশেষ করে ওপার বাংলার নতুন প্রজন্ম নজরুলের সৃষ্টি সম্পর্কে খুব কম জ্ঞানই রাখেন। তবে ‘পিপ্পা’য় নজরুলের গানের সুরের বিকৃতিরূপ দেখে সেখানকার মানুষ যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ আইনজীবী র্যাড ক্লিফের কলমের খোঁচায় দুই বাংলাকে ভাগ করা হলেও রবীন্দ্রনাথকে যেমন ভাগ করা যায়নি, ঠিক তেমনই কাজী নজরুল ইসলামকেও ভাগ করা সম্ভব নয়। নজরুল বাঙালির হৃদয়ে চির জাগরূক।
নজরুলের দুর্ভাগ্য, বিতর্ক তার পিছু ছাড়েনি। নজরুলকে বলা হয় অসাম্প্রদায়িক কবি। গান-কবিতা এবং অন্যান্য সাহিত্য রচনা ছাড়াও নজরুল ব্যক্তিগতভাবেও অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। তিনি কখনো জাত-পাতের বিচার করেননি। সৃষ্টিশীল কর্মে, ধর্মবর্ণনির্বিশেষে তিনি যেভাবে অসম্প্রদায়ের কথা বলে গেছেন, বাংলা সাহিত্যে, অন্য কারও কাজে সেভাবে তা দেখা যায়নি। বিতর্ক তাকে আজও পিছু ছাড়েনি বলার একটি উদ্দেশ্য আছে। নজরুল অসাম্প্রদায়িক হয়েও অতিসম্প্রতি একটি সাম্প্রদায়িক ঘটনার শিকার হয়েছেন। এ বছরের মে মাসেই পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপের এক নাটমন্দিরে একটি রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছিল; কিন্তু অতিসাম্প্রদায়িক কিছু মানুষের আপত্তির মুখে সে অনুষ্ঠানে নজরুলের ছবি টানানো সম্ভব হয়নি। এ প্রসঙ্গটি এখানে উল্লেখ করা হলো এ কারণে যে, ধর্মীয় আত্মবিশ্বাসে ভর করে কেউ কেউ নজরুলকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করলেও এ আর রহমানের দেওয়া সুরকে কেন্দ্র করে ধর্মবর্ণনির্বিশেষে মানুষ যেভাবে নজরুলের সৃষ্টির পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। নজরুলের অপমানের প্রতিবাদে যে অগ্নিশিখার মতো তারা জ্বলে উঠেছেন তাই বা কম কীসের!
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের অংশবিশেষের ঘটনাকে অবলম্বন করে ‘পিপ্পা’ সিনেমাটি চিত্রায়িত হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২০-২১ নভেম্বর যশোরের গরিবপুর গ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী সম্মিলিতভাবে সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। গরিবপুর গ্রামটি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে যে, এ গ্রামটি দখল করতে পারলে চৌগাছায় অবস্থিত পাকিস্তানের ১০৭ পদাতিক ব্রিগেডের সঙ্গে যশোর সেনানিবাসের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হবে, তাতে তাদের যুদ্ধের রসদ সরবরাহের বিঘ্ন ঘটবে। অপরদিকে, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত সম্মিলিত বাহিনীর পক্ষে যশোর সেনানিবাসে সহজে পৌঁছানো সম্ভব হবে। এখানে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্মিলিত বাহিনীর মূলত ট্যাংকযুদ্ধ হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্ব শুরু হওয়ার ১০ দিন আগেই এ যুদ্ধটি সংঘটিত হয়। যদিও তখন পর্যন্ত মিত্রবাহিনী গঠিত হয়নি, তবু এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা কম ছিল না। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্ব শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর। গরিবপুর যুদ্ধ নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার বলরাম সিং মেহতা ‘ব্যাটেল অফ গরিবপুর’ নামে একটি বই লেখেন। বলরাম সেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তখন তিনি ক্যাপ্টেন ছিলেন। তার স্কোয়াড্রন কমান্ডার মেজর দলজিত সিং নারাং যুদ্ধের শুরুতেই নিহত হলে সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে ক্যাপ্টেন মেহতা যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তার লেখা বই ‘ব্যাটেল অব গরিবপুর’-এর কাহিনি নিয়েই এ ‘পিপ্পা’ সিনেমাটি চিত্রায়িত হয়। এ সিনেমায় মোট পাঁচটি গান আছে। তার মধ্যেই একটি গান হলো ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’। মুক্তিযুদ্ধের সময় বহুল প্রচারিত এ গানটি মুক্তিযোদ্ধাদের যে অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছিল, তা কেবল মুক্তিযোদ্ধারাই বলতে পারবেন। এ কালজয়ী গান শুধু যুদ্ধের ময়দানে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদেরই অনুপ্রেরণা জোগায়নি; দেশ ও দেশের বাইরে সব বাঙালির মনে দেশমাতৃকার জন্য প্রাণ উৎসর্গের খোরাকও জুগিয়েছিল। নির্মাতারা হয়তো মুক্তিযুদ্ধকালীন সেই বাস্তবতাকে মনে রেখেই এ গানটি নির্বাচন করেছিলেন তাদের সিনেমায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। তারা নিজেরাও হয়তো বুঝতে পারেননি, এ আর রহমানের মতো একজন ব্যক্তি গানটির এমন দশা করে ছাড়বেন। এ আর রহমানেরও উচিত ছিল মুক্তিযুদ্ধে এ গানের বাস্তব অবদানের কথা স্মরণে রেখে সুর ও তাল ঠিক রাখা। অর্থাৎ, গানের কথা ও কথার সঙ্গে যে তাল বজায় রেখে নজরুল সুর করেছিলেন, তা অবিকৃতি রাখা।
এ আর রহমান যতই প্রতিষ্ঠিতই হন না কেন, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটিতে তিনি যে বিকৃতি ঘটিয়েছেন, তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। নজরুলের এ গানের যে প্রতিবাদী সুর বাঙালির মনে গেঁথে গিয়েছে, এ আর রহমান সেটাকে কোনোভাবেই সমমর্যাদায়ে পরিস্ফুটিত করতে পারেননি। গানের সেই বৈপ্লবিক সুরব্যঞ্জনা এখানে অনুপস্থিত। সোজা কথা, কিছুই হয়নি। নতুন করে সুরারোপ করতে গিয়ে এ আর রহমান সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। এ গানে নজরুল যে প্রবল প্রতিবাদী সুরে আহ্বান জানিয়েছিলেন, যেমন, ‘লাথি মার, ভাঙ রে তালা/যত সব বন্দী শালায়-/আগুন জ্বালা,/আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি।’, এমন কথা ও অগ্নিঝরা সুরের মাধ্যমে বিপ্লবীদের রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া কেবল নজরুলের পক্ষেই সম্ভব ছিল। এ গানের তীব্রতাই হলো এর মূল ‘স্পিরিট’। এ আর রহমান এ যুগের যত বড় সংগীতকারই হন কেন, নজরুলের গানের সেই ‘স্পিরিট’-এর ধারে-কাছে দিয়ে যাওয়ার যোগ্যতাও তিনি প্রমাণ করতে পারেননি। গানের মাধ্যমে নজরুলের এ আহ্বান ব্রিটিশবিরোধী সেই অগ্নিগর্ভ সময়ে জেগে ওঠা দেশপ্রেমের তরঙ্গকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। তার সেদিনের সেই আহ্বান, অত্যাচারিতদের বিরুদ্ধে বহুকাল পরে, এ যুগেও সমভাবে প্রয়োজ্য। একশ বছরেরও বেশি সময় আগে লেখা নজরুলের এ গানটি আজও একই রকম জীবন্ত। এ নিবন্ধে স্থানের স্বল্পতাহেতু, এ গান লেখার প্রেক্ষাপট এবং পরবর্তী ঘটনাবলি নতুন করে এখানে উল্লেখ করা হলো না। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সম্প্রতি বিভিন্ন মাধ্যমে বহুবার তা ব্যাপক আলোচিত হয়েছে।
এ আর রহমানের যোগ্যতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করছে না। প্রশ্ন উঠছে, অন্যের সুরারোপিত গানের প্রতি তার সততা নিয়ে। তিনি অবশ্য এর আগে বঙ্কিমের ‘বন্দে মাতরম্’ নিয়ে সাফল্য পেয়েছিলেন। যদিও সেখানে বঙ্কিমের লেখার খুব সামান্যই ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ এখানে বিকৃতির ঘটনা তেমন কোনো দাগ কাটেনি। যদিও তারও আগে, ওই একই কাব্য-বয়ানে প্রচুর সুর করা হয়েছে। গানটি ভারতে জনপ্রিয়তা পেয়েছে সন্দেহ নেই। সাধারণ শ্রোতারা গানটি গ্রহণ করেছে। এ আর রহমান হয়তো ভেবেছিলেন, নজরুলের এ গান দিয়ে তিনি আরেকটি বাজিমাত করবেন; কিন্তু সেটি আর ঘটেনি। তবে ‘বন্দে মাতারম্’ গানের পেছনে তিনি প্রচুর চিন্তাভাবনা ও শ্রম দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। এছাড়া এ আর রহমান ‘জোধা আকবর’ ছবিতেও গানের সুরারোপ করতে গিয়ে প্রচুর খেটেছেন। বিশেষ করে সুফি ঘরানার গান ‘খাজা মেরে খাজা’ গানটিতে সুর দিতে গিয়ে সুফি গান ও সুরের ওপর প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন। নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে গানটি বেঁধেছিলেন বলে তো জনপ্রিয়তাও পেয়েছে প্রচুর। নজরুলের গানের প্রেক্ষাপট নিয়ে তিনি এতটুকুও যে ভাবেননি তা বোঝা যায়। শত বছর আগের লেখা এ গান নিয়ে কাজ করার আগে তার এর ইতিহাস ঘেঁটে দেখা উচিত ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, অবিভক্ত ভারত ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এ গানের অবদানের কথা তিনি কেন জানার চেষ্টা করলেন না? গানটি নিয়ে কাটাছেঁড়া করার আগে এ আর রহমানের আরেকটু গবেষণা করা জরুরি ছিল। তার বোঝা উচিত ছিল, নজরুল শুধু একজন গীতিকারই ছিলেন না, নিজে গান বুঝতেন, গান গাইতে পারতেন, গানের শিক্ষকও ছিলেন তিনি। নজরুল নিশ্চয়ই অনেক ভেবে-চিন্তেই এ সুর দিয়েছিলেন; স্বরলিপিও তৈরি করেছিলেন।
স্বরলিপির কথা যখন উঠল, তখন এ স্বরলিপির মতো নজরুলের আরও অনেক সাহিত্যসম্পদ সংরক্ষণ নিয়ে কথা বলা যায়। এ কথা ঠিক, ‘পিপ্পা’ নজরুলের সৃষ্টিশীল কর্ম সংরক্ষণের গুরুত্বটা বুঝিয়ে দিয়ে দিল। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে অতীতের মতো বর্তমানেও নজরুলের সৃষ্টিশীল কর্মের যে বিকৃতি ঘটছে, তা আবার নতুন করে আলোচনায় এলো। এ বিষয়ে ইদানীং কিছু প্রতিবন্ধকতার কথাও শোনা যাচ্ছে; বিশেষ করে নজরুল পরিবারের বিভাজনের কথা। ‘পিপ্পা’ সিনেমার নির্মাতারা বলছেন, ‘নজরুল পরিবারের সঙ্গে করা চুক্তির শর্ত মেনেই তারা এ গান পুনর্নির্মাণ করেছেন।’ অবশ্য, চুক্তির সময় উপস্থিত সাক্ষী, নজরুলের অন্যতম নাতি কাজী অনির্বাণ, গানের সুরের এমন বিকৃতি ঘটানোর কোনো কথা বা শর্ত চুক্তিতে ছিল না বলে জানিয়েছেন। তাদের এ বিভাজন অপ্রত্যাশিত এবং কাঙ্ক্ষিতও নয়। এর একটি বিহিত হওয়া দরকার। নজরুল পরিবারের সদস্যরা ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অনুরোধ করেছেন, বাংলাদেশের আদলে ওখানেও যেন একটি নজরুল ইনস্টিটিউট করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ব্যক্তিগত উদ্যোগে নজরুলের বিষয়ে এরই মধ্যে বেশকিছু ভালো কাজ করা হয়েছে। আশা করি, নজরুল ইনস্টিটিউট করার ব্যাপারে নজরুল পরিবারের সঙ্গে সেখানকার শিল্প ও সংস্কৃতিমনা সুধীজনরাও একমত হবেন। ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানের বিকৃতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে তারা যে প্রতিবাদমুখর হয়েছেন; কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিশীল কর্মকে সংরক্ষণের জন্য সে দেশের সরকারকে রাজি করাতে একইভাবে তারা এগিয়ে আসবেন। তাতে শুধু নজরুলের সারা জীবনের সৃষ্টিই রক্ষা হবে না, একই সঙ্গে বাংলা শিল্প ও সাহিত্য জগতের অমূল্য সম্পদও সংরক্ষিত হবে।
Leave a Reply